ধলি
-----| সুখ সাহারা


শ্বেত রোগটা প্রথমে ঠোটের একপাশে ছিল, এরপর আস্তে আস্তে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। আর তারপর থেকে জমিলা নাম বদলে তার নাম হয়ে গেল ধলি।

 স্বামীর ঘরে নতুন কম বয়সী বউ আসল। তালাক না দিলেও স্বামীর ঘরে আর তার জায়গা হল না। তিন বছরের সবুজকে কোলে নিয়ে ধলিকে ঘর ছাড়তে হল। ভাইদের ঘরেও জায়গা হল না। ভাতিজা ভাতিজিরা নিজের ফুপু আম্মাকে দেখে ভয় পায়! তার চেহারা এখন ভয়ংকর! ছোট বাচ্চারা তাকে দেখিয়ে বলে,,
-মা দেখ ভুত..

প্রথম প্রথম ধলির খুব কষ্ট লাগত!! সে কি এমন পাপ করেছিল যে আল্লাহ তাকে এই বিশ্রী অসুখটা দিল!!
কিন্তু এখন আর অত খারাপ লাগে না। আস্তে আস্তে সব সয়ে যায়। দুঃখ, কষ্ট, অনুভূতি....

 কেউ তাকে থাকার একটা জায়গাও দিল না। বাধ্য হয়ে শ্বশানের পাশে খালি জায়গাটায় একটা ছাপড়া তুলে দিন কাটাতে লাগল!!

মানুষের ভালোবাসা না পেলেও সে পশুপাখির ভালোবাসা পেল। তার ঘরের পাশে পুরাতন শিমুল গাছ। সেখানে রাজ্যের পাখি সারাদিন রাত কিচিরমিচির করে। সন্ধ্যায় সব পাখি তার ঘরের আঙিনা জুড়ে খেলতে থাকে।

যে কোন গাভীকে ধলি দুমিনিটেই পোষ মানাতে পারে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সে গাভীর দুধ দোয়ার কাজ নিল। কত দেশি বিদেশি হোমরা-চোমরা গরু,,
তার ভয় করে না কখনো। একটু গলায় হাত বুলিয়ে ময়না ডাকলেই খুব সহজেই পোষ মেনে যায়।

অথচ ধলি তার স্বামীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল, কই সে তো বুঝল না....

ধলি দুইটা কালো গাই আদিতে নেয়। খুব যত্ন করে। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করায়।
আস্তে আস্তে তার পশু প্রেমের কথা গ্রামের সবাই জানতে পারে। সবাই তাদের গরু, ছাগল ধলিকে আদিতে দিতে চায়।
কিন্তু ধলি তো সবার গরু ছাগল নিতে পারে না। তাকেও সংসারের কাজ করতে হয়। ছেলে সবুজের জন্য রান্না করতে হয়। ছেলে স্কুলে পড়ে।সে যা খেতে পছন্দ করে তাই যোগার করার চেষ্টা করে ধলি। সে যত কষ্ট পেয়েছে ভাতে কাপড়ে, ছেলেটা যেন কষ্ট না পায়!
ছেলেটা গরুর গোশ খেতে ভালোবাসে। কিন্তু ধলি গরু, ছাগল পাখির গোশত খেতে পারে না। তার গলা দিয়ে নামে না।
তবুও শুধু ছেলের জন্য এক কেজি গোশত এনে সিদ্ধ করে রেখে রেখে এক সপ্তাহ ছেলের পাতে তুলে দেয়।
এই ভূবনে ছেলে ছাড়া আপনার বলতে তো আর কেউ নেই!

সবুজের এস এস সি পরীক্ষার সময় তার একমাত্র গাইটা বেচঁতে হয়।

যেদিন সবুজের রেজাল্ট ছিল সেদিন সকাল থেকে ধলি জায়নামাযে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে। ভয়ে সারাক্ষণ বুকের ভিতর টিবটিব করছিল, কি জানি কি হয়....
পাশ দিতে পারবে তো সবুজ...
সারাটাদিন ধলির অপেক্ষায় কাটে। সবুজ ঘরে ফেরে রাতে, ক্লান্ত হয়ে।
ধলি জিঙেস করে-

-কিরে বাবা, তোর রেজাল্ট কি?
-পাশ করছি মা।

ক্লান্ত গলায় বলেই সবুজ ঘুমিয়ে পড়ে। সবুজের মুখে সিগারেটের গন্ধ পায় ধলি।

ছেলেটাও কি তবে বখে গেল? ধলির কষ্ট লাগে!
পরক্ষণেই নিজেকে সান্তনা দেয়!!
বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নিশ্চয় এমন করেছে! তার সবুজ এমন হতেই পারে না।
আর কেউ না বুঝুক, ছেলে নিশ্চয় তার কষ্ট বুঝবে...!!!

সবুজ বড় হয়েছে। চাকরী পেয়েছে। নিজে নিজেই বিয়ে করছে। করবেনা বা কেন? কে আছে তার, যে বিয়ে দেবে। মা একটা, তবু ধলারোগী।
বউ দেখতে খুব মিষ্টি।
সবুজ কিসের যেন চাকরী করে।আলাদা ভাড়া বাসায় বউ নিয়ে থাকে। একটা নাতীও হয়েছে ধলির। কিন্তু নাতীও তাকে ভয় পায়। ভয় পাওয়ারই কথা।
কালো জমিলা যে এখন পুরোপুরি ধলা হয়ে গেছে!!

ধলির আর এখন কষ্ট হয় না!! চোখের জল আসেনা। দুঃখ, কষ্ট, সুখ, অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে গেছে!!

সন্ধ্যায় যখন তার ছোট ছাপড়া ঘরের আঙিনা জুড়ে নাম না জানা হাজার খানেক পাখি এসে কিচিরমিচির করে তখন সে সব কিছু ভুলে যায়....
তার আর একলা লাগে না।
সে ভালোবাসা বোঝে,,
এই অবলা পশু-পাখির ভালোবাসা


No comments


আদিপ্রাণ | মাহিগঞ্জ সাহিত্য সংসদ

মোট দর্শন

4784